Opinion from Sajib Shehzad, Student of Shahjalal university of sceince and technology.
শিক্ষকরা তাদের অর্জিত জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের মনে যায়গা করে নেয় । যুগে যুগে বহু শিক্ষক তার কাজের মাধ্যমে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে। একজন শিক্ষকের কাজ হচ্ছে তার অর্জিত সুস্থ জ্ঞান, আচরণ এবং দর্শন তার শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া যাতে করে একটা শিক্ষিত, মার্জিত এবং সচেতন জেনারেশন তার মাধ্যমে তৈরী হয়। অন্যদিকে শিক্ষক যদি হয় দুর্নীতিপরায়ণ,স্বার্থপর এবং তার উদ্দেশ্যে যদি হয় শিক্ষকতার নামে নিজ স্বার্থ হাসিল করা তখন মানুষের মাঝে সে ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠে।
নারায়ণগঞ্জের বক্তাবলীতে কানাইনগর ছোবহানিয়া স্কুল এন্ড কলেজ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অতীতে প্রতিষ্ঠানটির অর্জিত বেশ সুনাম থাকলেও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় নাজেহাল অবস্থা। জনাব আমজাদ হোসাইন দীর্ঘকাল প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এতো বছরের শিক্ষকতার পরেও এলাকার মানুষ এবং তার নিজ শিক্ষার্থীদের মনে তিনি জায়গা করে নিতে পারেন নি। শিক্ষকতা পেশায় বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতি এবং অনিয়মের বেড়াজালে নিজেকে আটকে রাখার ফলেই হয়তো শিক্ষার্থীদের সাথে তার সুস্থ সম্পর্ক তৈরী হয়নি কখনো।
একটি সুন্দর প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির কারণে কিভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তার জ্বলন্ত প্রমাণ কানাইনগর ছোবহানিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজ। দুর্নীতির দায়ে প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসাইনের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক শিক্ষার্থী সহ এলাকাবাসীরা বিভিন্ন সময় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গও। তবে সবকিছুর পরেও যেনো অদৃশ্য এক শক্তি দুর্নীতিবাজ আমজাদ হোসাইনকে আকড়ে ধরে রেখেছে।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় আমজাদ হোসাইনের বিরুদ্ধে। ৪ জুলাই বুধবার দুপুর সাড়ে ১২ টায় এডিসি শিক্ষা অফিসার শরিফুল হাসান স্কুল পরিদর্শনে আসার খবর পেয়ে প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসেন তার কক্ষ তালা দিয়ে পালিয়ে যান।এ সময় এডিসি শিক্ষা অফিসার রেজাউল বারী এলাকাবাসী ও ছাত্রছাত্রীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেনী কক্ষ ঘুরে দেখেন এবং আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পান। পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।এ সময় ইংরেজী শিক্ষক কাদির খান সহ ১২ টার সময় বিদ্যালয় আসার কারনে ৬জন শিক্ষককে হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত দেখান। ( সূত্র নিউজপ্রতিদিন)
২০১৯ সালে শিক্ষক আমজাদ হোসাইনের বিরুদ্ধে ১.৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছিলো,প্রমান হিসেবে দেওয়া হয়েছিলো স্কুলের রশিদ, ব্যাংক একাউন্টসহ নানা তথ্য-উপাত্ত। তার পপরিপ্রেক্ষিতে ১২ই মার্চ আমজাদ হোসাইনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা শিক্ষা অফিসার জনাব শরিফুল ইসলাম। একই বছরের ২৭ আগস্টেও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের একাডেমিক সুপার ভাইজার এইচ এম এ মালেক অভিযোগের বিষয়ে তদন্তে আসেন।
২০২১ সালের আগস্ট মাসে আবার তদন্ত শুরু করেন তোলারাম কলেজে অধ্যক্ষ বেলা রানী সিংহ, তদন্ত শেষে বেলা রানী সিংহ দুর্নীতির কিছু সত্যতা পেয়েছিলেন বলে জানান। তবে বরাবরের মতো আমজাদ হোসাইন তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করায় অধ্যক্ষ বেলা রানী সিংহ তার কাছ থেকে সমস্ত তথ্য এবং ডকুমেন্টস চায় এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না দেখাতে পারলে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সত্য বলে গন্য করা হবে বলেও জানান তিনি । প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসাইন তখন ৩ দিনের সময় চায়। তবে সে সময় আর শেষ হয়নি। পরবর্তীতে অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলা প্রশাসনকে।
দুর্নীতি প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসাইনকে কতটা গ্রাস করেছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় গত জুন মাসে যখন খোদ শিক্ষকরাই তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেন।
টিচার্স টাওয়ার’ নির্মাণে বড় অঙ্কের দুর্নীতির জবাব দিতে আমজাদ হোসাইনকে আইনী নোটিশও দেওয়া হয়েছে । ওই নোটিশে বলা হয়েছে, আমজাদ হোসেনসহ আরও দুইজন মিলে ৫৫ লাখ ৮১ হাজার ৬২৪ টাকা আত্মসাত করেছেন। এড. আবু তাহের মিয়া স্বাক্ষরিত একটি নোটিশ সূত্রে জানা যায় ২৮ জন শিক্ষক মিলে ফতুল্লার হরিহরপাড়ায় একটি যৌথ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ‘টিচার্স টাওয়ার’ নামের ওই ভবন নির্মাণের জন্য প্রত্যেকে ১১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা করে মোট ৩ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা করেন। ওই টাকা টিচার্স টাওয়ার কমিটির তৎকালীন সভাপতি আমজাদ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন ও কোষাধক্ষ্য আব্দুল খালেকের নিকট জমা হয়। কিন্তু ভবন নির্মাণের নামে ওই তহবিল থেকে তিনজনের যোগসাজসে সেখান থেকে ৫৫ লাখ ৮১ হাজার ৬২৪ টাকা আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ তোলেন বর্তমান সভাপতি মোঃ মনির হোসেন। (সূত্র : শিক্ষাতথ্য.কম)
উপরোক্ত দুর্নীতির ঘটনাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, আমজাদ হোসাইন প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানটি আরো নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলো। শিক্ষকদের অনিয়ম, দুর্নীতি, গ্রুপিং, কোচিং বানিজ্য, শ্রেনি কক্ষে অনিয়মিত পাঠদান ইত্যাদি ছিলো খুব সাধারণ বিষয়। ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম হওয়ার পর সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা হয়েছে আমজাদ হোসাইন প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন সময়ে।
অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়ার কারনে বিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকরাই প্রধান শিক্ষকের কোন নির্দেশ মানেন নি। প্রায় সকল সিনিয়র শিক্ষকরাই সময়মত বিদ্যালয় আসেন নি। আবার সময়ের আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেছেন। যারা সময় মত আসতেন তারাও নিজেদের কোচিং কিংবা প্রাইভেট বানিজ্যের জন্য আসতেন। শিক্ষকদের চেইন অব কমান্ড এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলো যে প্রধান শিক্ষক অন্য সহকারী শিক্ষকদের দ্বারা লাঞ্চিত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অবিভাবকদের সাথে মিসবিহেইভ করার মতো অভিযোগও পাওয়া গেছে।
আমজাদ হোসাইন থাকাকালীন সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে চোখে পরার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি, বরং দেয়াল দসে যাওয়া , শিক্ষার্থী আহত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে অনেক।
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং মান অনুধাবণ করা যায় প্রতিষ্ঠানটির
শিক্ষার্থীদের অর্জন এবং সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের অবদান দ্বারা। দুঃখের বিষয় বিগত কয়েকবছরে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারে নি, সামাজিকভাবেও শিক্ষার্থীরা সচেতনতার ভূমিকা পালন করতে পারছেনা। এর পিছনে শিক্ষার্থীরা না যতটা দায়ী তার চেয়ে দায়ী প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা। দুর্নীতিবাজ প্রধান শিক্ষক, যোগ্যতাহীন শিক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি আজ ভরপুর। শিক্ষকরা নিজেরা যদি সচেতন না হয়, নিজেদের মধ্যে যদি পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকে শিক্ষার্থীদের বোঝানোর মতো, তখন সে প্রতিষ্ঠান থেকে যোগ্য শিক্ষার্থী বের না হওয়াটাই স্বাভাবিক। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীরা এখন পড়াশোনাকে এক প্রকার বোঝা মনে করে বেড়াচ্ছে। যা ভবিষ্যতে বক্তাবলী এলাকার শিক্ষার উপর বিরুপ প্রভাব ফেলবে।অবশ্য আমজাদ হোসাইন থাকাকালীন সময়ে বক্তাবলী এলাকার সচেতন মহল স্কুলে একটি সুস্থ কমিটি প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি এটাই হয়তো আমাদের বিশাল একটি দুর্বলতা, যার কারণে আমজাদ হোসাইনের মতো দুর্নীতিবাজরা জবাবদিহিতার শিকার হয়নি, যেমন খুশি তেমনভাবেই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে গেছেন প্রতিষ্ঠানটিকে।
আমজাদ হোসাইনের বিদায়ের সাথে সাথে একটি কালো অধ্যায়ের বিদায় হয়েছে কানাইনগর ছোবহানিয়া হাই স্কুল এন্ড কলেজ নামক বক্তাবলীর এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি থেকে। বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন ফিরোজ স্যার। স্যারকে অভিনন্দন। আশা রাখি ভবিষ্যতে আমরা একজন যোগ্য প্রধান শিক্ষক পাবো যিনি এই কালো অধ্যায়টাকে কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করবেন এবং সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাববেন।
প্রতিষ্ঠানটির মান ও উন্নয়ন বৃদ্ধির জন্য এলাকার বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষানুরাগী,সাবেক শিক্ষার্থীসহ সচেতন মহল সবাইকে একসাথে কাজ করে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানটিতে এখনো যেসব অযোগ্য শিক্ষকরা পাঠদান করছে তাদেরকে প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে যোগ্য এবং সৎ শিক্ষক নিয়োগের প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। আমার বিশ্বাস এলাকার শিক্ষিত-সচেতন মহল এবং সাধারণ জনগন যদি চায় তাহলে প্রতিষ্ঠানটিকে আবারো আমাদের আশার বাতিঘর বানানো সম্ভব। যেখান থেকে বের হয়ে আসবে শত শত শিক্ষিত-সচেতন কিশোর-কিশোরী, যারা বক্তবলীকে নিয়ে যাবে বহুদুর।